True

 

'আপনাকে বলছি স্যার : বারবারিয়ানা স্কুল থেকে' বইটির পাঠ প্রতিক্রিয়া
শেখ বিবি কাউসার


 আপনাকে বলছি স্যার : বারবিয়ানা স্কুল থেকে

ভাষান্তর : সলিল বিশ্বাস 

সকল শিক্ষক ও যারা শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান তারা বইটি পড়লে আশা করি অনেক উপকৃত হবেন। কারণ বইটি পড়া যখন শেষ করলাম তখন শিক্ষক হিসেবে  নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলাম। হয়তো আপনিও দেখতে পারেন আপনার প্রতিচ্ছবি। বইটির প্রতিটি লাইন মনের গভীরে গিয়ে স্পর্শ করবে আপনাকে, যদি আপনি একজন শিক্ষক হয়ে থাকেন। আবার হয়তো অনেকে এদের মতামত সব মানতে পারবেন না। কিন্তু এই বইটি পড়ার পর কোনো শিক্ষক অবিচলিত থাকবেন এমন ভাবাও কঠিন। দরিদ্র গ্রাম্য স্কুলের ছেলেদের লেখা এই বই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মানুষের জীবনে আশ্চর্য পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এ বই এর ‘আমি' আটজন তরুণ লেখকের সম্মিলিত ব্যক্তিত্ত্ব আর 'আপনি' হলেন তাদের পরিচিত সকল শিক্ষক। 

রিভিউটি শুরু করছি ' আপনাকে বলছি স্যার’ এর প্রথম উক্তি ‘প্রিয় স্যার’  দিয়ে। “আমাকে আপনার মনে পড়বে না।আমার নামও নিশ্চয় আপনি ভুলে গেছেন। আপনি আমার মতো অনেককে ফেল করিয়েছেন। আমি কিন্তু আপনার কথা অনেক ভেবেছি, আপনার মতো শিক্ষকদের নিয়ে চিন্তা করেছি। সেই সব ছেলেমেয়েদের কথা মাথায় ঘুরে বেড়িয়েছে,যাদের আপনারা ফেল করিয়ে কলে- কারখানায় আর মাঠে ছড়িয়ে দেন আর বেমালুম ভুলে যান তাদের কথা”। আসলেই আমরা শিক্ষক হিসেবে সব ছাত্রকে সমান দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখি তা কিন্তু বলা মুশকিল। দেখা যায় প্রায় সময় আমরা শিক্ষকরা 'ভালো' ছাত্রদের মুখের দিকে তাকিয়ে পড়াই,যারা পড়া পারে না তাদের অনেক সময় কট্টক করি। পিছিয়ে পড়া যে ছেলেকে আমরা ফেল- এর মার্ক দিই, কোনো দিন ভেবে দেখি নাই তার সমস্যা কোথায় বা কেন। মা-বাবা যখন তাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায় তখন আমরা তার কথা বেমালুম ভুলে যায়। 

বারবিয়ানা স্কুলের ছেলেদের কথাগুলো আপনার, আমার চোখ খুলে দিবে। তারা বলে, “ অথচ যারা পারছে না তাদেরই তো সাহায্য বেশি করে দরকার, তেলা মাথায় তেল ঢেলে কী হবে? কজন ছাত্র খুব ভালো ফলাফল করেছে, তার বদলে উৎকর্ষের মাপকাঠি হওয়া উচিত কত বেশি ছাত্র শিক্ষার এক স্তর থেকে আর এক স্তরে এগিয়ে দেওয়া যাচ্ছে, কত কম ছাত্র বর্জিত হচ্ছে।  যেমন যে হাসপাতাল কেবল সুস্থ মানুষের জন্যে তাকে হাসপাতাল বলাই যায় না! দুনিয়াজুড়েই শিক্ষকদের ভাবনা হওয়া উচিত এ নিয়ে। তাই  ‘প্রিয় স্যার’ সম্বোধন দিয়ে বইটি শুরু। 

বারবিয়ানা : আসুন এবার জেনে আসি যে বিষয়টাকে  কেন্দ্র করে বইটি রচিত।

ইতালির টাসকানি প্রদেশের মুজেল্লো অঞ্চলের পার্বত্য এলাকায় বিশটি খামার নিয়ে গঠিত একটি জনবসতি-বারবিয়ানা। আছে ছোট্ট একটি গির্জা। ১৯৫৪ সালে পাদ্রি ডন লোরেনজো মিলানি আসেন গির্জাটির ভারপ্রাপ্ত হয়ে। তিনি এখানে এসে দেখলেন এ অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জগৎ বলতে কিছু নেই। বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই হয় পরীক্ষায় ফেল করে স্কুল ছেড়ে দিয়েছে,অথবা যেভাবে স্কুলে শিক্ষাদান করা সে বিষয়ে তাদের তিক্ততার শেষ নেই।এই তিক্ততা তাদের নিরুৎসাহিত করেছে এবং আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরিয়েছে। মিলানি প্রথমে এমন দশটি ছেলেকে জড়ো করলেন। যাদের বয়স ১১-১৩ বছর। তাদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হলো।  কিছুদিনের মধ্যে আরও দশটি ছেলে এসে জুটল।এখন বয়সে যারা বড় তারা ছোটদের সময় দিতে লাগলো। তাদের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব সমস্যাবলি নিয়ে অনুশীলন আর সেসব সমস্যার ভিতরে ঢোকার চেষ্টায় কাটত অনেকটা সময়। 

বইটি পড়তে গিয়ে পাওলো ফ্রেইরি নামে একজন শিক্ষক ও দার্শনিকের নাম জানতে পারলাম। ব্রাজিলীয় বংশোদ্ভূত মানবতাবাদী শিক্ষক পাওলো ফ্রেইরির (১৯২১-৯৭) শিক্ষাভাবনা বিগত এবং চলমান শতাব্দীতে সারা দুনিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। তাঁর শিক্ষাতত্ত্ব আমাদের দেশের বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান, বিষয় করে যারা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা, বয়স্ক সাক্ষরতা ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করছে তারাও প্রয়োগ করে আসছেন। তার শিক্ষা ভাবনার মূল কথা হলো শিক্ষা প্রক্রিয়া হবে অংশগ্রহণমূলক,যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী আলোচনা বা মতবিনিময়ের মাধ্যমে নিজেদের এবং জগৎ সম্পর্কে জানতে। বারবিয়ানা স্কুলেও পাওলো ফ্রেইরির শিক্ষাতত্ত্ব অনুসরণ করা হয়েছে। “শুনেছি  'সেমিনারি'তে নাকি ছেলেরা জীবনের ব্রত নিয়ে চিন্তা করে যদি প্রাথমিক স্কুলেই তাদের বলে দেয়া হতো ‘ আমাদের সকলেরই ব্রত হলো সর্বত্র শুধু মানুষের উপকার করা,তাহলে তারা কেবল নিজের নিয়ে মাথা ঘামিয়ে জীবনের শ্রেষ্ঠ বছরগুলো নষ্ট করত না।” উল্লেখ্য, এখানে সেমিনারি বলতে ধর্মশাস্ত্র শিক্ষার স্কুল, যেখানে ভবিষ্যৎ ধর্মযাজকদের প্রশিক্ষণ চলে।

আসলেই তারা আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে যদি আমরা শিশুদের ভেতর কথাটি (ব্রত হোক মানুষের উপকার করা) ঢুকিয়ে দিতে পারতাম তাহলে বড় হয়ে হয়তো চুরি, দুর্নীতি, মানুষকে ঠকানো, মিথ্যা বলা ও অসৎ পথে বড় হওয়া এগুলো অনেকটা কমে আসতো। এক সময় ‘নিরক্ষরতা দূরীকরণ’ কথাটি বেশি শোনা যেত।কিন্তু এখন মানুষ সাক্ষরতা অর্জন করেছে।কিন্তু জ্ঞান অর্জনের পথে আমরা কতটুকু সফল? লেখকের ভাষায় “আমি পরিত্যাগ করছি সেই ভ্রান্তিকে যা মনে করে সাক্ষরতা আর শিক্ষা, তথা জ্ঞানার্জন সমার্থক। বই তখনই হাতিয়ার হয়ে ওঠে যখন মানুষের মনে ঘটে বিশ্লেষণী চেতনার উন্মেষ"।  এখন আমরা প্রায় সবাইতো শিক্ষিত কিন্তু প্রকৃত  জ্ঞান অর্জন করাটাই হলো সবচেয়ে বড় শিক্ষা। 

অনেক সময় আমরা শিক্ষকরা পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করতে গিয়ে অনেক ধরনের মন্তব্য লিখে দিই।যেমনঃ দুর্বল,নিকৃষ্ট,অপরিণত,ছেলেমানুষি,শিশুসুলভ, বিষয়বস্তু কম,ধারণা দুর্বল এরকম কতগুলো কাটা কাটা কথা। কিন্তু লেখা উন্নত করে তোলার জন্য কোনো পরামর্শ দিই কী? লাইনটা পড়তে গিয়ে একটা কথা মনে পড়ে গেল। কিছুদিন আগে ডিগ্রি পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করছিলাম। হঠাৎ শেষ পৃষ্ঠার নিচে দেখি একটা ছোট্ট চিঠি। ছাত্রটি এটি লিখেছেন যিনি খাতা মূল্যায়ন করবেন তার উদ্দেশ্যে। চিঠিটির মূলবিষয়বস্তু ছিল পরীক্ষায় যেন তাকে পাস করিয়ে দেয়া হয়।  আমরা যারা শিক্ষক তারা প্রায় সময় কথাটি পরীক্ষার খাতায় পেয়ে থাকি।এটা অবাক হওয়ার কোন বিষয় নয়।কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো ছাত্রটি ‘স্যার’ বানানটি লিখেছে ‘চার' এভাবে। একজন ডিগ্রি ছাত্রের কাছ থেকে এই ধরনের ভুল আশা করা যায় না। তখন আমার মনে হলো আসলে ও যে 'স্যার' বানানটায় ভুল লিখল এটা কী শুধুই ওর দোষ? আমি বলব, না, এটা ওর একার দোষ না। দোষটি আমরা যারা তাদেরকে প্রাইমারি থেকে কলেজ পর্যন্ত পড়িয়ে এসেছি সবার। আমরা তাদের স্বপ্ন দেখাই কিভাবে  মুখস্থ করে বেশি বেশি নম্বর তোলা যায় কিন্তু স্বপ্ন দেখাই না কিভাবে বড় মনের মানুষ হতে হয়।

তারা বলেছে, “ যে স্কুল ছাত্র বাছাই করে সে স্কুল ঈশ্বর বিরোধী,মানবিকতার শত্রু”। ভেবে দেখলাম বিষয়টা অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক। এই বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা ছাত্রদের মধ্যে পার্থক্য ঢুকিয়ে দিই তুমি ভালো ছাত্র, আমি খারাপ ছাত্র। এই প্রক্রিয়াটি আমাদের দেশে অনেক নামিদামি শিক্ষা  প্রতিষ্ঠান (সব না) করে থাকে। তারা ভালো ভালো ছাত্র নিয়ে খেতাব পায় ভালো স্কুল নামে। আসলে একটু ভাবুন তো সেই স্কুলগুলোকে কী ভালো স্কুল বলা যায়? যারা ভালো ভালো ছাত্রগুলোকে বাছাই করে নিয়ে নেয়! বারবিয়ানার ছাত্রদের দাবি ছিল শিক্ষায় থাকবেনা কোনো বৈষম্য। শিক্ষা হবে সবার জন্য সমান।

তারা শিক্ষককে শিক্ষাদানে আন্তরিক হতে বলছেন। কিশোর কিশোরীকেও কি স্নেহ-মমতা-উৎসাহ-যত্ন ছাড়া শিক্ষাদান সম্ভব? তাই বারবিয়ানার ছাত্ররা দোষী করেছে স্কুলের পরিবেশকে আর এই পরিবেশ যেহেতু অনেকটাই শিক্ষককের ওপর নির্ভরশীল তাই তারা শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতার অনেকটা দায়ই ফেলেছে শিক্ষকের দোরগোড়ায়।  তারা চেয়েছে আমরা শিক্ষকরা যেন তাদের দিকে মায়া-মমতার দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। হিংসাত্মক কিংবা লোভাতুর দৃষ্টিতে নয়।

শিক্ষায় উৎসাহ দানের অপরিহার্যতা এখন মনস্তত্ত্বের প্রতিষ্ঠিত সূত্র। সেটা শিশু হোক কিংবা কিশোর কিশোরীর জন্যই হোক। আমি মনে করি আমাদের প্রতিটি ছাত্রছাত্রীরা হলো এক একটি বেলুনের ন্যায়।বেলুনকে যেমন শুধু ফুঁ দিলে সে আকাশে নিজে নিজে উড়তে পারে ঠিক তেমনি আমাদের ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ,অনুপ্রেরণা, সাহস দিলে তারাও বেলুনের মতো নিজে নিজেই উড়তে পারবে মুক্ত আকাশে। তাই বারবিয়ানার ছেলেরা দুনিয়ার শিক্ষকদের উদ্দেশ্য করে বলছে, “ সত্যি যাতে ছাত্রছাত্রীর শিক্ষালাভ ঘটে তা দেখার জন্য আপনারা যদি সময়, আগ্রহ ও দরদ নিয়ে তৎপর হন,তাহলেই কেবল অবস্থা পাল্টাবে। ধন্যবাদ। 


শেখ বিবি কাউছার 

প্রভাষক

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ 

রাউজান, চট্টগ্রাম। 

ইমেইল : koucherihc14@gmail.com


 

পাঠ প্রতিক্রিয়া : গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে